ভাবুন তো-আপনি অনেক কষ্টে কিছু টাকা জমালেন। ঠিক করলেন শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করবেন। কিন্তু হঠাৎ শুনলেন, মার্কেটে অনেক রকম “loophole” আছে, যেগুলো ব্যবহার করে কিছু মানুষ অন্যদের ঠকায়। তখনই প্রশ্ন জাগে আমি কীভাবে এই ফাঁদ থেকে বাঁচব?
আসলে শেয়ার বাজারে loophole মানে হলো সিস্টেমের এমন কোনো ফাঁক-ফোকর, যেটা ব্যবহার করে কিছু লোক বেআইনি বা অসাধু সুবিধা নেয়। এর ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু সুখবর হলো-আপনি সচেতন থাকলে, তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিলে আর কিছু বেসিক নিয়ম মানলে, এই ঝুঁকি থেকে অনেকটাই সুরক্ষিত থাকা যায়
আজকের লেখায় আমি আপনাকে এমন কিছু প্র্যাকটিক্যাল টিপস, বাস্তব উদাহরণ আর সহজ উপায় বলব, যেগুলো মেনে চললে আপনি শেয়ার মার্কেটের যেকোনো loophole থেকে অনেকটাই নিরাপদ থাকতে পারবেন।
শেয়ার মার্কেটে সাধারণ loophole গুলো
চলুন, আগে দেখি এই “loophole” জিনিসটা আসলে কেমন হতে পারে।
১. Insider Trading
এটা হলো যখন কোনো কোম্পানির ভেতরের লোক (যেমন ম্যানেজমেন্ট বা বড় শেয়ারহোল্ডার) এমন তথ্য জানে যেটা এখনো পাবলিক হয়নি। তারা সেই তথ্য ব্যবহার করে শেয়ার কিনে বা বেচে ফেলে। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
উদাহরণ: ধরুন, কোনো কোম্পানি বিশাল প্রফিট করেছে, কিন্তু এখনো বাজারে ঘোষণা দেয়নি। ভেতরের লোক আগে থেকেই শেয়ার কিনে ফেলল। ঘোষণার পর দাম বেড়ে গেল, তারা লাভ তুলে নিল কিন্তু আপনি জানতেনই না।
২. Circular Trading
কিছু অসাধু ট্রেডার একে অপরকে বারবার একই শেয়ার কিনে-বেচে বাজারে ভলিউম বাড়ায়। এতে মনে হয় শেয়ারের ডিমান্ড খুব বেশি, অথচ আসলে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানো হচ্ছে।
৩. Wash Sale
এটা এক ধরনের “tax loophole”। অনেক দেশে নিয়ম আছে-একটা শেয়ার লস করে বিক্রি করলে সেই লস ট্যাক্সে ধরা যায়। অসাধু বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে আবার অল্পদিনের মধ্যেই কিনে নেয়, যাতে লস দেখানো যায় কিন্তু শেয়ারও থেকে যায়।
৪. Pump and Dump Scheme
অনেক সময় সোশ্যাল মিডিয়া বা ফোরামে কোনো শেয়ারের অতিরিক্ত প্রচার করা হয়। নতুনরা লোভে পড়ে কিনে ফেলে। দাম বাড়লে বড় খেলোয়াড়রা শেয়ার বিক্রি করে দেয়, আর সাধারণ মানুষ ক্ষতির মুখে পড়ে।
৫. Accounting Loophole
কিছু কোম্পানি তাদের রিপোর্টে আসল লস লুকিয়ে রাখে। কাগজে-কলমে সুন্দর দেখায়, অথচ ভেতরে ভেতরে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।
তাহলে এসব থেকে আপনি বাঁচবেন কীভাবে?
এবার আসি আসল কথায়-প্র্যাকটিক্যাল টিপস।
১. সবসময় তথ্য যাচাই করুন
কোনো শেয়ার কেনার আগে শুধু খবর শুনে ঝাঁপ দেবেন না। কোম্পানির অফিসিয়াল রিপোর্ট, SEBI (ভারতের ক্ষেত্রে), NSE বা BSE-এর ওয়েবসাইট থেকে তথ্য যাচাই করুন।
২. অতি লোভনীয় অফার এড়িয়ে চলুন
যদি কেউ বলে-“এই শেয়ারে ইনভেস্ট করলে ডাবল হয়ে যাবে”-তাহলে বুঝবেন, এর মধ্যে কোনো না কোনো ফাঁদ আছে। শেয়ার মার্কেটে “sure profit” বলে কিছু নেই।
৩. ডাইভারসিফাই করুন
সব টাকা এক কোম্পানির শেয়ারে রাখবেন না। ব্যাংক, IT, ফার্মা, এনার্জি-বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করে রাখুন। এতে কোনো এক সেক্টরে সমস্যায় পড়লেও পুরো টাকা একসাথে ডুবে যাবে না।
৪. রেগুলেটরির আপডেট ফলো করুন
ভারতে SEBI নিয়মিত নতুন গাইডলাইন দেয়। এগুলো পড়ার অভ্যাস করুন। এতে নতুন নতুন loophole বা প্রতারণার ধরন সম্পর্কে আগেই জানতে পারবেন।
৫. Stop-Loss ব্যবহার করুন
যে দামে আপনার ক্ষতি মেনে নেওয়া সম্ভব, সেই পর্যন্ত অটোমেটিক বিক্রির অর্ডার দিয়ে রাখুন। এতে বাজার যতোই অস্থির হোক, বড় ক্ষতি থেকে বাঁচবেন।
৬. সোশ্যাল মিডিয়ার হাইপ থেকে দূরে থাকুন
সোশ্যাল মিডিয়ার অনেকে শেয়ার টিপস দেয়। বেশিরভাগ সময় এগুলো “pump and dump” কৌশলের অংশ হয়। তাই কোনো টিপস শুনলে যাচাই না করে বিনিয়োগ করবেন না।
৭. Long-Term ভিউ রাখুন
শেয়ার মার্কেটের আসল লাভ আসে দীর্ঘমেয়াদে। স্বল্পমেয়াদি লোভ বা গুজবের ফাঁদে পড়লে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি।
বাস্তব গল্প: হারশদ মেহতা কেলেঙ্কারি
ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় স্ক্যামগুলোর একটি ছিল হারশদ মেহতা স্ক্যাম (১৯৯২)। তিনি ব্যাংকের সিস্টেমের loophole ব্যবহার করে হাজার কোটি টাকার শেয়ার কিনেছিলেন। প্রথমে বাজার চড়া দামে উঠল, সবাই খুশি। কিন্তু যখন ফাঁস হলো, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা ডুবে গেল।
এই ঘটনার শিক্ষা হলো-যখনই বাজারে হঠাৎ অস্বাভাবিক উত্থান হয়, তখন সতর্ক হতে হবে। এর পেছনে কোনো কৃত্রিম খেলা থাকতে পারে।
আপনার করণীয়
সবসময় ছোট থেকে শুরু করুন।
নিজের রিসার্চ ছাড়া কারো কথায় অন্ধভাবে বিশ্বাস করবেন না।
স্টক মার্কেট শেখার জন্য ভালো বই বা ট্রেনিং নিন।
সিস্টেমের প্রতিটি পরিবর্তন বা গাইডলাইন আপডেট রাখুন।
সন্দেহজনক লেনদেন দেখলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানান।
উপসংহার
শেয়ার মার্কেটে loophole সবসময়ই থাকবে। কারণ যেখানে টাকা, সেখানেই সুযোগসন্ধানী মানুষ থাকবে। কিন্তু আপনি যদি সচেতন হন, সঠিক তথ্য ব্যবহার করেন এবং অযথা লোভ না করেন-তাহলে এই ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।
মনে রাখবেন, শেয়ার মার্কেট হলো ম্যারাথন, স্প্রিন্ট নয়। ধীরে ধীরে, নিয়ম মেনে এগোলে শুধু loophole থেকে বাঁচবেন না, বরং ভবিষ্যতে ভালো রিটার্নও পাবেন।